Read time: 1 mins

মানুষ যা নিয়ে বাঁচে

by Shagufta Sharmeen Tania
20 September 2022

Translated from English to Bangla by the author

 

সারা শীতকাল পচতে থাকা বাগানে মাটি এখন শুকিয়ে এসেছে, ঘাসচাপা একটা গর্তে পা পড়ে আচমকা মচকে গেল। কোথা থেকে গর্ত এলো? শেয়ালের? নাকি সজারুর? ছোট ছোট সজারু আসে বাগানে, ঝুনঝুনির মতো শব্দ করে করে। সজারুটার নাম আমরা রেখেছি পিনকুশন। গর্তটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে পায়ের ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বাড়ি এলাম। এমন দিনেই পা হড়কালাম, যেদিনটা ভারী সুন্দর একটা দিন, বিলেতে এমন দিনকে বলে ফোর সিজনস ইন আ ডে, ষড়ঋতুময় দিন। এই আকাশভরা আলো, আকাশের রঙ তুর্কি চিনেমাটির পেয়ালার মতো নীল-উজ্জ্বল। আবার কিছুক্ষণ পরই জানালার শার্সিতে বৃষ্টির ঝাপটা আর বাতাসে সিকামোরের বীজ ঘুর্ণি পাকিয়ে এমন সব প্রান্তরে উড়ে যাচ্ছে যেখানে সব ধূসর।  

ভোরে খানিকটা বৃষ্টি হয়ে যাবার পর রোদ উঠলে আমি বাগানে গেছিলাম, পড়শিদের বেড়ায় হানিসাকলের লতাটায় ঘিয়ে রঙা হানিসাকল ধরেছে, গন্ধে পাড়া মাত, কত স্মৃতি উসকে দেয় এ বাগান। বাগানে ঢুকবার পথে শামুক মাড়িয়ে দিতাম বলে আমার ছেলে ছোট্টবেলায় ডুকরে উঠতো তুমি স্নলি শামুককে মাড়িয়ে দিলে!! পাড়ার পার্কের পুকুরে একটা ম্যালার্ড হাঁস চরতো, আমার ছেলে সেটাকে ডাকতো ডেঞ্জেল হাঁস মহাশয়একবার আমাদের শহর ছেড়ে প্রায় তিনশ মাইল দূরে লেক ডিস্ট্রিক্টে গেছি, ঝর্ণার জল এসে মিলছে হ্রদের জলে, সেখানকার ম্যালার্ড হাঁসগুলোকে খেলতে দেখে সে চেঁচিয়ে উঠেছিলডেঞ্জেল হাঁস মহাশয়, তুমি এখানেও আমাকে দেখতে এসেছ! সবকিছুর নাম ছিল তার দুনিয়ায়, বাতাসের আগে ধেয়ে চলা সিকামোরের বীজেরও নাম ছিল নিশ্চয়ই। ওকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। নাম দেয়া আমাদের বংশগত স্বভাব।  

মনে আছে, কৃষিমেলা থেকে একটা মহুয়াগাছ এনে ছোটচাচা আমাদের কল্যাণপুরের বাড়ির সামনে পুঁতলো, একটা ভাঙা স্লেটের পাতে লিখে সেই গাছের কবিত্বপূর্ণ নাম দেয়া হলো ফুলঝরিয়া, ইংরেজিতে লেখা হলো ইন্ডিয়ান হানি ট্রি, ল্যাটিন নামও লেখা হলোমধুকা ইন্ডিকা। আম্মা দেখে চোখ সরু করে দেবরকে জিজ্ঞেস করলো ফলদ গাছ না বনজ? 

-আরে, ফল তো হবেই গাছে! 

-সেই ফল খাওয়া যায়? 

-যায় না মানে! বিহার-টিহারের দিকে লোকে খায় শুনেছি। এই যে তোমার ছেলেপুলেরা পেট ফুলিয়ে ঘুরছে, মহুয়ার তেলে কৃমি দূর হয়। গরুতে খেলে ফোয়ারার মতো দুধ দেয়।  

-আমাদের তো গরু নেই।  

-এর বীজ থেকে বনস্পতি ঘি তৈরি হয় জানো! 

– আগের টিনটাই এখনো ফুরায়নিআমাদের তো বনস্পতি দরকার নেই। 

-তখন থেকে নেই নেই করছো কেন। এই তো আছে। প্রমাণমাপের একটা মহুয়া গাছ আছে। একদিন মিটার বিশেক লম্বা হবে এই গাছ। ছোট ছিলাম বলে মায়ের সাথে ছোটচাচার মনান্তরের কারণ বুঝতে পারিনি। ছোটচাচাকে কেউ বলেছিলগরম দুধে পদ্মমধু আর শুকনো মহুয়াফুল চূর্ণ মিশিয়ে পান করলে বীর্যশক্তি বাড়ে, সেটা ছোটচাচা বড়ভাবীকে বলবে কী করে! 

গাছটা কিন্তু বছরের পর বছর আমাদের নিরাশ করে ছোট্ট চারাগাছ রয়ে গেল। বাড়লো না, পূর্ণিমা রাতে ফুল ফুটিয়ে বাতাস আলোড়িত করলো না, ঘি কিংবা কৃমির ওষুধের ব্যবস্থাও করলো না। একসময় ছোটচাচার পাগলামির লক্ষণ প্রকাশ পেল, পাগলামি সারাতে তাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়া হলো, সেই বিয়ে ভেঙেও গেল, ভুগে ভুগে একদিন ছোটচাচা মরেও গেল। অতদিন আমাদের গাছটার কথা মনেও পড়েনি, গাছটাকে ঢেকে দিয়ে দিব্যি বাগানবিলাস আর ভাদ্রাফুলের লতা উঠেছে। আশপাশের বাড়িতে আঙিনায় আর ছাদে লাউ-কুমড়া-টমেটো এইসব ফলেছে, ভাঙা বালতিতে পুদিনা, শীতকালে দুচারটা গোলাপ-গাঁদা-পাতাবাহারএদের ভেতর মহুয়া বড় বিসদৃশ হবে বলেই সে আর হয়তো ফুটতে গা করেনি।  

এক বসন্তে মাথাঝাড়া দিয়ে উঠলো সেই ফুলঝরিয়া গাছ। রোদের তাপে ঝিলমিল করতে লাগলো তার তামাটে থোকা থোকা পাতা, ধুসর কান্ডে সময়ের চলাচলের মতো বড় বড় ফাটল। রাতে কল্যাণপুর মাতোয়ারা করে সারা গাছে মাদক ফুল ফুটলো, ভোরে ঝরতে লাগলো। চৈত্রের রোদে ঘুরে ঘুরে পড়শিদের বাড়ির ছাগলগুলো সেই ফুল-পাতা খেয়ে তাগড়া হয়ে উঠলো। সন্ধ্যে থেকে রাজ্যের মাদকাসক্ত কলাবাদুড় এসে ঝুলতে থাকলো গাছে। বাসনমাজুনি মুরাদের মা আমার মায়ের গলায় জিজ্ঞেস করলোএই গাছে ফল হয় না কাঠ হয়? কোনোটাই হয় না শুনে সে বল্লো পাতাগুলো ছাতিমের পাতার মতো দেখায়। তারপরই দাবী করলো বাদুড়ের ছ্যাপ গায়ে পড়ে তার গায়ে খুব চুলকানি হয়েছে, তবে দাবীটাকে কেউ খুব একটা পাত্তা দিল না। আমাদের কম্পাউন্ডের দেয়ালে যারা পোস্টার সেঁটে যায়, যারা ঘুঁটে শুকাতে দিয়ে যায় শপাশপ, যারা গেট খোলা পেলেই নিচতলার কল খুলে গোসল করে যায়, সারাক্ষণ যারা অন্যেরটা নিয়ে খায় তাদের সবার ওপর দিয়ে মাথায় বাড়তে লাগলো আমার সঙ্গী সেই মহুয়া গাছটা। কিন্তু অত ছোট পাড়ায় অত বড় বৃক্ষের বেড়ে উঠবার কিছু অসুবিধে আছে। মিউনিসিপ্যালিটির কিছু অলিখিত নিয়ম আছে তো! মাপমতো না হলে যে বেশ মুশকিল, সেটা ঐ মধুবৃক্ষের মতো আরেকজন বুঝেছিল। সেই গল্পে আসি।  

আমাদের মেজচাচা থাকত অফ জিন্দাবাহার লেন, আমাদের বই বাঁধাইখানা থেকে সামান্য দূরের এক গলিতে। মেজচাচা একবার রোজার মাসে ছোটচাচার অসমাপ্ত জীবনকর্ম নিয়ে একটা স্মরণসভার আয়োজন করলো, আমরা গেলাম। গিয়ে দেখি মেজচাচার বাড়িতে মস্ত এক খরগোশ ঘুরে বেড়াচ্ছে, চাচি তার নাম রেখেছে মধু। টুকটুকে লাল চোখ। শারদ মেঘের মতো শাদা ধবধবে। আকারে ছোটখাট হরিণছানা বা ছাগলের মতো বড়। ডান কানে উল্কি করে লেখা বি-৫২। প্রতিবেশীদের কেউ বলেছেএই খরগোশ বেলজিয়াম থেকে পিজি হাসপাতালে গবেষণার জন্য আনা, ওখানকার ল্যাবে প্রাণীর ওপর নিরীক্ষা হতো। সেখান থেকে মধু পালিয়ে গেছিল সম্ভবত, এইজন্যই কানে নাম লেখা। মেজচাচা আমাদের র‍্যাবিট আর হেয়ারের তফাত বোঝাচ্ছিল। কিন্তু জ্ঞানগর্ভ আলোচনার চেয়ে শাহবাগ থেকে পালিয়ে জিন্দাবাহার লেনে আসতে পারা একটা খরগোশ অনেক বেশি মনোযোগ দাবী করে। তো মধুর পিছু নিয়ে চাচির রান্নাঘরে গিয়ে দেখি, মাটির মেঝেয় উথালপাথাল গর্ত। জিয়লমাছের হাঁড়ি উল্টে পড়ে ঘরময় মাগুরমাছ বুকে হাঁটছে। মধুর আর দোষ কি, সে সামনের দিকে তাকিয়ে পেছনবাগে যায়, গর্ত খুঁড়তে গিয়ে ওর পাছায় লেগে হাঁড়িপাতিল পড়ে যায়। চাচি ক্লান্তগলায় জিজ্ঞেস করলোতোরা এরে নিবি? আমি আর আমার ফুপাতো ভাই সেতু লাফিয়ে উঠলাম খুশিতে। বড়রা তারাবীর নামাজ পড়তে গেলে ইতিউতি তাকিয়ে পাটের ছালায় ভরে মধুকে বাড়ি নিয়ে আসলাম।  

এভাবেই আমাদের ছোট্ট বাড়িতে মাপমতো হয় না এমন আরেকটি জীবের আবির্ভাব ঘটলো। বাড়ির সবাই তাকে দেখে মহাখুশি, ভারী মনোহরণ দেখতে সে। তার নামটা সে জানতো, খাটের তলায় ধুলিময় হাঁড়িপাতিল আর সিন্দুকের রাজত্বে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকতো। ডাক শুনলে কান নাড়তো, কিন্তু পাত্তা দিত না। টেনেটুনে কোলে নিলে অক্লান্ত আদর নিত। সেতু বলতোখরগোশের ভাষায় আমরা একটা শব্দ জানি না, অথচ খরগোশ আমাদের ভাষায় অন্তত একটা শব্দ জানেমধু। বাড়ির বিড়ালটাও একটা মনুষ্য শব্দ জানতো, সাটিন, তার নিজের নাম। সাটিন মধুকে দেখলে ঘাবড়ে গিয়ে চুপ করে যেত, আরে সিংহের মতো বসে আছে বিড়াল, তার গায়ে তাগ করে মধু ঝাঁপ দিত। বিলাইয়ের হাড্ডিতে অনেক কিছু সয়, সৌষ্ঠবের ব্যাঘাত সয় না।  

কয়েকদিনেই বাড়ির লোক অতিষ্ট হয়ে উঠলো। আমার ঘরের বিছানায় পাতা দাবার বোর্ড- চাদররাশিফল সব ওলোটপালোট করে রাখতো মধু। যখন থাকতাম না সে তখন আপনমনে খেলে বরবাদ করে দিত সব দাঁত সুলসুল করলেই চপ্পলের ফিতা থেকে সার্টের কলার সব চিবিয়ে ফেলতো, আম্মার শখের পাকিস্তান আমলের মুলতানি গুলটেক্সের নরম মোটা চাদরটাও খেতে বাকি রাখতো নাআম্মা একদিন হুবহু মেজচাচির গলায় সেতুকে জিজ্ঞেস করলোতোরা এরে নিবি? মধু ছালাবন্দী হয়ে কল্যাণপুর থেকে মতিঝিল এলো। 

সেতুর মা মানে ফুপু থাকতেন বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনিতে দুর্ভিক্ষ শেষ তখন, স্বাধীনতার সময় কলোনির বিল্ডিং-এ ঢোকার রাস্তায় তোলা পাঁচিলগুলো তখনো ভাঙা হয়নি। সেখানে তখন অবারিত জায়গা। বড়সড় সবুজ মাঠ, নিচু এলাকা থেকে সাপ-ব্যাঙ আসে কলোনির চারদিকে পিচ ঢালা রাস্তা। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় মাঠেসেতুদের বাড়িতে অন্য কলোনি থেকে লোকে মধুকে দেখতে আসতো। কেউ কেউ তাকে পালতে নিতে চাইতো। কেউ খেয়ে ফেলতেও চাইতো, খুরওয়ালা নয় বলে হালাল নয়এমনটা বলে সেতু নিরস্ত করতো। গায়ক আজম খানের চ্যাঙড়াদের গ্যাংটা একদিন ঘোষণা দিয়েছিল চিটাগাঙ হোটেলে নিয়ে মধুকে কেটেকুটে খাবে সেতুর দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না।  

এদিকে মধু সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়ায়, একদিক থেকে টানেল খুঁড়ে বহুদূর গিয়ে বের হয়। সারা মাঠ মাধব ট্রেঞ্চে ভরা, ছেলেপুলেরা খেলতে পারে না। সন্ধ্যা হলে সে নিজেই বাড়ি ফেরে, নাকভরা নখভরা কাদামাটি তুরতুরে নাক-নাড়াটা দেখলেই সেতু গলে জল হয়ে যায়।  

একদিন সন্ধ্যায় সে আর এলো না। তিনচার দিন ধরে কোনো খবর নাই। ফুপু আর সেতুর কান্না দেখে কে পঞ্চম দিনে ফোন পেলাম, আরামবাগের এক বাসায় নাকি মধুকে দেখা গেছে। আমি আর সেতু গেলাম। কিন্তু সেবাড়ির লোকে প্রমাণ চায়। কানে উল্কির কথা শুনেও তারা দিতে গররাজি। সেতু হঠাৎ ডেকে উঠলোমধু। নিজের নাম শুনে নদীভাঙনের মাটির মতো ঝপ করে একলাফে মধু কোলে চলে এলো 

সেতুর আনন্দ অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কর্তৃপক্ষ আর মধুকে কলোনিতে রাখতে রাজি নয়। মধু আবার মতিঝিল থেকে কল্যাণপুর এলো। যেদিন সে বাড়িতে এলো, সেদিন বাসার সামনের রাস্তা চওড়া করা হবে বলে মহল্লার সবাইকে নিয়ে ওয়ার্ড কমিশনারের সাথে আলোচনা চলছে। মধুকে নিয়ে বেশি আপত্তি করার সময় ছিল না কারো। শীতশেষের সন্ধ্যা। ভ্রমণপরিশ্রান্ত মধুকে একঝুড়ি ফুলকপির ডাঁটা আর পাতা দিলাম, সে মনের সুখে খেতে লাগলো। সেতু সেরাতে আমাদের বাড়িতেই ছিল, আমরা পাতাঝরা আঙিনায় হেঁটে হেঁটে যুক্তি করলাম, মধুকে মধুবৃক্ষ মানে মহুয়াগাছটায় তুলে দেব, কেউ দেখতে পাবে না, ও ওখানেই থাকুক। কবে যেন মধু একটা নারকেলের মতো মহাসাগরে ভাসতে ভাসতে আমাদের এই ডাঙায় উঠে এসেছিল, ভিনদেশী রাঙা রাজপুত্র, কাদামাটিতে তার জায়গা হতে চায় না। 

মধুকে সেই ফুলঝরিয়া গাছে তোলা হয়েছিল কি না তা আমি কিছুতেই মনে করতে পারি না। সেরাতের সভায় স্থির করা হয়েছিল, দশফুটের রাস্তা বার ফুট চওড়া করলে আমাদের সবার বাড়িতে সারাবছর ভাড়াটে কিলবিল করবে, ভাড়া বাড়বে…অতএব মহুয়াগাছটা কাটা পড়বে। ফলের গাছ তো না, কাঠেরও না, আজদাহা একটা গাছ সবকিছু ছায়া করে দাঁড়িয়ে আছে! নেশাড়ু মানুষ মহুয়ার খোঁজে দিনে-রাতে বাড়ির আঙিনায় ঢোকে। মধুকে পরে সেতু আর আমি কাজী নাসিমের বাগানবাড়িতে রেখে এসেছিলাম, একটা জার্মান শেফার্ড ছিল সে বাড়িতে। কাজী নাসিম পাইপ কামড়াতে কামড়াতে উৎফুল্ল গলায় বলেছিলেনআরে, একটা ফ্লেমিশ জায়ান্ট র‍্যাবিট! কই পাইলা তোমরা!  

শহর বাড়ছিল, আমাদের ছোট ছোট ঘরবাড়ির মাপের চেয়ে বড় সবকিছুই হারাচ্ছিল। ওখানে ফল হয় না এমন গাছের কিংবা দুধ দেয় না এমন প্রাণীর জায়গা হচ্ছিল না। শুধু মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখতামমহুয়াগাছটায় অনেক ভাইবেরাদরসহ মধু বসে জুলজুল করে চেয়ে আছে আর নাক নাড়ছে। দেশ ছাড়বার পরেও দেখতাম। বাগানসহ এই বাড়িটায় আসবার পর হলদে কুর্জেট, কাঁটাওয়ালা শসা, পুঁইশাক লাগাতে গিয়ে কতবার মনে হয়েছে এই বুঝি মধু এসে উল্টেপাল্টে দেবে বাগানের কালো মাটি। এখানে মধু নেই, কিন্তু তার সাঙ্গপাঙ্গরা আছে। শামুকের অত্যাচারে লালশাকের অঙ্কুর গজাতে না গজাতেই শেষ, মটরশুঁটির লতা উঠবার আগেই স্লাগের খাওয়া সারা, সবজি তো বটেই টিউলিপের পেঁয়াজও মাটি খুঁড়ে শেয়ালে খেয়ে যায়আমি অকেজো চাষা মরসুমের সেলেরিয়াক কিংবা বীট তুলতে ভুলে গেছি এমনও হয়েছে কখনো, অসময়ে শাবলের আগায় উঠে এসেছে দৈত্যের স্ত্রীর স্তনাকার বীট। আগাছা ওপড়াতে গিয়ে আমার একদিন মনে হলোএই উদ্ভিদ আমার জন্যে জরুরি নয় বলে কি এটি জগতের এত বিপুল আয়োজনে জরুরি নয়? সেদিন থেকে আমার চাষাবাদের ইতি। ঘাসটুকুও ছাঁটি না, ঝোপ বড় আবাসিক, কতরকম প্রাণী এসে বাসা করে ঘাসের ঝোপে যেন আমার ইতিবাচক সিদ্ধান্তকে অভিবাদন জানাতেই বাতাসে উত্তাপ বাড়ামাত্র ঘাসের ফাঁকে গজিয়ে উঠলো গোলাপিরঙের রেড ক্যাম্পিয়ন, লাইল্যাক পমপমের মতো দেখতে ক্লোভার, গাঢ় বেগুনি ন্যাপউড, কিছুটা বকফুলের মতো আকারের হলদে বার্ডস ফুট ত্রিফয়েল।  

পায়ে ব্যথার ওষুধ লাগিয়ে আজ আবার বাগানে এলাম। রবিবারের মন ভাল করা সকালে রাস্তায় তিনচারজন যীশুর নামগানে মত্ত কালো লোক ঝনঝনে যন্ত্র পিটিয়ে গাইছে গ্লোরি গ্লোরি হ্যালেলুইয়া… একসময় তাদের গান থামলো শোনা গেল চা-চামচে আরেকটা চা-চামচ পেটাই করার শব্দের মতো শিস দিচ্ছে ব্লু টিট পাখি, গুনগুন করছে ভোমা মৌমাছি, এরা সবাই জানে শহরে তারা উন্মূল, খানিকটা আমারই মতো। কোথাও গিয়ে আমরা উদ্বাস্তুর মতো পরস্পরের মিত্র। হৃদয়ের সবুজ ভেষজ খুঁজতে কতটা এলাম 

বাগানের বেঞ্চেই বসে ছিলাম, মনে হলো সকালে যে গর্তে পা পড়েছিল সেই গর্তটা থেকে পুঁতির মতো গোলগোল চোখে কে যেন চেয়ে রয়েছে। চোখজোড়া সতর্ক অথচ শান্ত, বুদ্ধিমান, এমন কারো চোখ যে মানুষের ভাষায় অন্তত একটা শব্দ জানে।  


Illustration © Jessica Hinerangi 

About the Author

Shagufta Sharmeen Tania

Born in Bangladesh and initially trained as an architect, Shagufta Sharmeen Tania has authored nine books. She translated Susan Fletcher’s Eve Green and Antonio Skarmeta’s Burning Patience, from English to Bengali. Her work has appeared in Wasafiri, Asia Literary Review, City Press and Speaking Volumes Anthology and Massachusetts Review. Shagufta received the Bangla Academy Syed Waliullah […]

Related