আশির দশক থেকে ঢাকার সাহিত্য মহলে জোরেসোরে চালু হয়েছে – ‘ঢাকা হবে ভবিষ্যৎ বাংলা সাহিত্যের রাজধানী।’ যতদূর মনে পড়ে, বাংলাদেশে আল মাহমুদ প্রথমে আয়োজন করে এ কথা বলতে শুরু করেন। অপরদিকে কোলকাতা থেকে ঢাকায় বেড়াতে এলে সুনীলগঙ্গোপাধ্যায়ও বন্ধু মহলে এ কথা বলতেন। তখন আমাদের বয়স ছিল কম, শুনতে ভালোই লাগত; বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনেহয়েছে–কথাটি নির্দোষ নয়। তার মানে আরো কোথাও বাংলা-সাহিত্যের রাজধানী আছে বা ছিল–তার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করাও এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির এক সঙ্গে বাস করার যেমন ভালো অভিজ্ঞতা আছে, তেমন তিক্ত অভিজ্ঞতারও অভাব নেই। এই তিক্ততা কেবল হিন্দু-মসলিম দুটি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রিয়া করেনি–বর্ণাশ্রম ও অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভক্ত সমাজের মধ্যেও বিদ্যমান।
ভূগোলের তেমন পরিবর্তন না হলেও রাজধানী ও রাষ্ট্রের পরিবর্তন হয় দেদার। তবু রাষ্ট্রকে মেনে চলা নাগরিকের বাধ্যবাধকতার অংশ, এর ব্যত্যয় রাষ্ট্রের আইনে সর্বোচ্চ অপরাধ হিসাবে বিবেচিত। রাজা যেখানে বাস করেন, রাজ্যের রাজধানীও সেখানে। রাজাকে কেন্দ্রকরে কেবল সেনা ও খাজাঞ্চিখানাই গড়ে ওঠে না, কবি-সাহিত্যিকরাও জড়ো হতে থাকে রাজার চারপাশে। রাজা ছাড়া ইনাম জোটে না, সমঝদার জোটে না। ইনাম না জুটলে পেট চলে না, সমঝদার না পেলে মন ওঠে না। কবি যতই তার বৃত্তিকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করুকনা কেন, শেষমেষ রাজদরবারই নির্ধারণ করে দেয়–তার শ্রেষ্ঠত্ব। বাঙালির আদি কবি জয়দেব চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণের গুণকর্তন করলেও গৌড়েশ্বর জয়পত্রের মুখোমুখি তাদের হতে হয়েছে। সুতরাং রাজা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের রাজধানীও পরিবর্তনহয়েছে।
ইতিহাসে বাংলার রাজধানী অনেকবার পরিবর্তন হয়েছে – পাল-সেন-তুর্কি ও সুলতানি আমলে এক রাজধানী ছিল না। বাংলায় মোগল নবাব আমলে সাহিত্যের কদর তেমন না থাকলেও বিভিন্ন রাজা, ভূঁইয়া ও জমিদারদের বৈঠকখানায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। ইংরেজ আমলে কোলকাতাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যের নতুন রাজধানী জমে ওঠে। কবি-সাহিত্যিকগণ কিছুটা রাজার অনুগ্রহ পেয়ে থাকলেও তারাযে সর্বদা রাজার গুণগান গেয়েছেন এমন নয়। পাল-যুগের প্রাপ্ত চর্যাপদে বৌদ্ধ ধর্মের আধিক্যের কারণ তখনো এ ভাষাভাষীর জীবনবোধের অভিজ্ঞতা বহুমুখী চেতনায় প্রবাহিত হয়নি।
সেন দরবারে বাংলার চেয়ে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাধান্য ছিল বেশি। বীরভূমের কেদুলি গ্রামের জয়দেব ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যে লিখেছিলেন। সেন দরবারের আরেকজন গুণী কবি ‘ধোয়ী’–তিনিও নবদ্বীপের বাঙালি; কিন্তু নিজ ভাষায় কবিতা লেখার সৌভাগ্য তাদের হয়নি। সেন রাজারা বাঙালি ছিলেন না–দক্ষিণের কর্নাটক থেকে এসেছিলেন। বিজয়সেন পাল বংশের শেষ রাজা মদন পালকে তার রাজধানী গৌড় থেকে উচ্ছেদ করেছিলেন। মদন পাল আরো কিছুদিন উত্তরবঙ্গে রাজত্বকরেছিলেন–তারপর সব কিছু সেনদের অধিকারে যায়।
মাত্র একশ’ বছর না যেতেই তুর্কি সেনা বখতিয়ারের হাতে লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী নদিয়ার পতন ঘটে। এটি অবশ্য তার অস্থায়ী রাজধানী ছিল – পালদের রাজধানী ‘গৌড়’কেই লক্ষ্মণ সেন পারে নিজের নামে লক্ষণাবতী রেখেছিলেন। রাজধানী নদিয়ার পতন ঘটলেও সেন বংশ আরো কিছুদিন ঢাকার বিক্রমপুরে রাজধানী স্থাপন করে ছিলেন। লক্ষ্মণ সেন নিজেও কবি ছিলেন, পিতার অসমাপ্ত বই ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভূত সাগর’ সমাপ্ত করেন। কিন্তু তার রাজধানীতে বাংলা-সাহিত্য চর্চা উপেক্ষিত ছিল। তার কারণ হতে পারে বাংলাভাষা তখনো তাদের দৃষ্টিতে কুলীন হিসাবে
মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি, তদুপরি রাজা নিজেও বাঙালি নন। তার আগে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী রাজারা যেহেতু সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন না–পালি এবং অপভ্রংশে তাদের আশ্রয়। সেদিক দিয়ে বলা যায়, পাল রাজধানীতে প্রথম বাংলা সাহিত্যের নাড়িপোতা হয়েছিল; পরবর্তী সেন আমলে তা উপেক্ষিত ছিল।
আদি বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে মুসলিম খিলজি-তুর্কি রাজধানীও তেমন কাজে আসেনি। খিলজি ও তুর্কি শাসনের প্রায় দেড়শ’ বছর বাংলা সাহিত্য চর্চার উল্লেখযোগ্য কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবিদরা তাই এটিকে ‘অন্ধকার যুগ’ হিসাবে বর্ণনা করতে চেয়েছেন। আর সে দায় বাংলার প্রথম মুসলিম শাসকদের উপরে বর্তায়, তাদের উপুর্যপরি ক্ষমতা দখলের লড়াই– কাউকেই থিতু হতে দেয়নি। দায়ী যদি করতেই হয় – সেই দায় থেকে সেন শাসকরাও মুক্ত নন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার–এ সময়ে রাজা বা রাজধানীর আনুকূল্য ছাড়াই চিৎপ্রকর্ষে বাংলা সাহিত্য সাবালকত্ব অর্জন করেছিল। সাহিত্যচর্চার লোকধারাটি সবসময় সক্রিয়ছিল। তা না-হলে আমরা চতুদর্শ শতকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর মতন এতটা পরিণত সাহিত্যকর্ম পেতাম না। সুতরাং সাহিত্যের রাজধানী-তত্ত্ব ক্ষমতা ও আধিপত্যবাদের সঙ্গে যুক্ত – এতে আর সন্দেহ কি।
চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে বাংলায় স্বাধীন সুলতানি আমল প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা ধরনের বাংলা সাহিত্য রচনার হিড়িক পড়েছিল–মঙ্গলকাব্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, রাধা-কৃষ্ণের পদাবলী। এছাড়া সুলতান ও তাদের অমাত্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃত থেকে, আরবি-ফারসি-হিন্দি থেকে অনুবাদ হচ্ছিল চিরকালীন সব গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য। কাশীরাম দাস, বেদব্যাস, শ্রীকর নন্দী ও কবীন্দ্র পরমেশ্বর রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ করেন–স্বাধীন সুলতানদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায়। এ সময় মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্তও বিপ্রদাস পিপিলাইসহ অনেকে মঙ্গলকাব্য রচনা করেন। গৌরাঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলায় অমর বৈষ্ণব-গীতি রচনার প্রাবল্য দেখা যায়।পাশাপাশি মুসলমান সাহিত্যিকদের রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান সুলতানি রাজধানীর অবদান।
স্বাধীন সুলতানদের ভাষা বাংলা না হলেও হয়তো প্রজাদের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য এবং সংস্কৃত থেকে দূরে থাকার জন্য তারা স্থানীয়কবিদের ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেছিলেন। তাছাড়া তখন পর্যন্ত বাংলা ছিল অচ্ছুৎ – উচ্চবর্গের মানুষজন তখনো বাংলাকে সাহিত্যেরভাষা হিসাবে মেনে নিতে পারেননি। মধ্যযুগে মানুষের বিনোদনের আর কোনো মাধ্যম না থাকায় সাহিত্য চর্চা সে অভাবও পূরণ করতেচেয়েছে। হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য কখনো রাজধানী গৌড়, লক্ষ্মণাবতী, নদিয়া, সোনারগাঁ, বিক্রমপুর এবং আরাকানের রাজধানী রোসাঙ্গে স্থানান্তরিত হয়েছে। মোগল সুবেদার ও নবাব আমলে বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকলেও সুলতানি আমলেরমতো কবিরা সেভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পাননি। কারণ সুবেদারদের ঠাঁইনাড়া ছিল দিল্লি, আর দিল্লির শাসকদের উৎসাহ ছিল আরবি-ফারসি ও সংস্কৃত সাহিত্যে–বাংলা তখন প্রাদেশিক ভাষার বেশি নয়।
বাংলায় কোম্পানি শাসনের শুরু থেকে ক্রমান্বয়ে বাংলা সাহিত্য ইংরেজের রাজধানী কোলকাতার দিকে সরে যেতে থাকে। ফোর্টউইলিয়াম কলেজের নবনির্মিত গদ্যভাষা, ইয়াং বেঙ্গলদের অভিঘাত এবং হিন্দু কলেজের নতুন শিক্ষার্থীদের বিদেশি ভাষা ও সাহিত্যশিক্ষার দ্বারা নতুন যুগের সূচনা হয়। এমনকি নববাবুর কোলকাতা উনিশ শতকের আগের বাংলার সাহিত্যের উত্তরাধিকার অস্বীকারকরে, কিংবা ‘মধ্যযুগ’-এর তকমা লাগিয়ে গ্রহণ করে। এখনো বাংলা
সাহিত্য উনিশ-বিশ শতকের কোলকাতা রাজধানী কেন্দ্রিক সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করে, যদিও সেই ধারা আজ ক্ষয়িষ্ণু। সাত-চল্লিশে বাংলা ভাগ হওয়ার পরে মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশের রাজধানীঢাকা সমান্তরালভাবে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির পথে এগিয়ে আসে। দেশের নানা প্রান্তর থেকে কবি-সাহিত্যিকরা ঢাকাকে কেন্দ্র করে জড়োহতে থাকে। নিঃসন্দেহে ঢাকা আজ সাহিত্য সৃষ্টিতে তার নিজস্বতা অর্জন করেছে। কিন্তু এ কথা আলাদা করে বলার দরকার হয় না যে–ঢাকা বাংলা সাহিত্যের রাজধানী।
এবার আল মাহমুদ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আগের প্রকল্পে ফিরে আসি। আল মাহমুদ ও সুনীলের ঢাকা বাংলা সাহিত্যের রাজধানী প্রকল্পের মধ্যে কিঞ্চিৎ পার্থক্য ছিল। সুনীল তার এই তত্ত্বের দ্বারা প্রধানত বাংলাদেশের পাঠক সমাজকে খুশি করতে চাইতেন – যাতে তাঁরবইয়ের বাজারে কাটতি বাড়ে; তাঁর এদেশীয় বন্ধুরা খুশি থাকে। তার কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন সততাও থাকতে পারে। কিন্তু আল মাহমুদ এরক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল সূক্ষ্ম মুসলিম জাতীয়তাবাদি রাজনীতি। যে প্রকল্পের অধীনে তিনি ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ লিখেছিলেন। তথাকথিত ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বহিরাগত মুসলিম শাসনের আগমনের দ্বারা ধর্মান্তরিত নিম্নবর্গের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মুক্তির স্বপ্ন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আল মাহমুদ তার ইউটোপিয়ায় বাস করলেও ঢাকা সাহিত্যের রাজধানী হিসাবে তাকে রক্ষা করতে পারেনি। নির্দিষ্ট ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি আস্থার ফলে একটি সময়ে যখন ঢাকার সাহিত্যকুল তাঁকে প্রায় একঘরে করে দিয়েছিল, তখন কিন্তু কোলকাতার সাহিত্যগোষ্ঠী তার প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রেখেছিলেন। এমনকি ঢাকাতে তাঁর সাহিত্যের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য কোলকাতার মাপকাঠি ব্যবহার করতেহতো তার অনুরাগীদের। এতে মনে হয় ঢাকা এখনো কোলকাতার মতো সাহিত্য বিচারে নিরপেক্ষতা ও সাবালকত্ব অর্জন করতেপারেনি। ঢাকার সাহিত্য সমাজ এখনো প্রায় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত বিবেচনার উপরে দাঁড়িয়ে সাহিত্য বিচার করে থাকে। ভালো সাহিত্য রচনার দ্বারা ঢাকার সাহিত্য সমাজে মান্যতা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সকল বিবেচনার আগে পাঠকগোষ্ঠী তার পছন্দের রাজনৈতিক প্রচারণার উপরে দাঁড়িয়ে থাকে। কোলকাতা বাংলা ভাষা-সাহিত্যের ব্যাপক ক্ষয়িষ্ণুতার যুগেও সাহিত্যের নিজস্ব বিবেচনা এখনো সেখানে বিদ্যমান। সাহিত্যের রাজধানী কেবল তখনই হওয়া সম্ভব যখন একজন লেখক রাজনীতি ধর্ম সংঘ ও গোষ্ঠীর বাইরে থেকেও চরম সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন না।
তবে কোলকাতা ও ঢাকার সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে একটা অবিশ্বাস । এই অবিশ্বাসের কারণ পরস্পর সম্বন্ধে কম জানা; পাশাপাশি ধর্মীয় অংশীদারিত্বের পার্থক্য। উনিশ শতকের কোলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যের সূচনা পর্বে তথাকথিত আধুনিক সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের অংশগ্রহণের অভাব এবং সাহিত্যের ইতিহাসকারদের দ্বারা মধ্যযুগের শক্তিশালী অংশীদারিত্বের প্রতি উপেক্ষা। যেমন সুকুমার সেন চারখণ্ডে ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ লেখার সময়ে আলাওল, দৌলত কাজী, শাহ মুহম্মদ সগির, সৈয়দ সুলতান-এর মতো কবিদের বাদদিয়ে যান। সারা মধ্যযুগে ‘পদ্মাবতী’র মতো শক্তিমান ভাষার কাব্য কম লেখা হয়েছে। পরে অবশ্য সুকুমার সেন তার রচনার সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারেন, লেখেন ‘ইসলামি বাংলা সাহিত্য’। কিন্তু এই নাম কতটা সঙ্গত? তিনি যদিও কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলেছেন–‘ইসলামি নামটি হয়ত সঙ্গত নয়, কেননা রচনা-রচয়িতা-ভাব-ভাষা কোন দিক দিয়েই এই সাহিত্যকে সর্বথা ইসলামি বলা যায় না। রোমান্টিক কাহিনি-কাব্যে পুরনো মুসলমান কবিদের বরাবরই একচ্ছত্রতা ছিল। কিন্তু কাব্যের বিষয় সর্বদা ফারসি সাহিত্যের অনুগত ছিল না।’ আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্যের এই মান্য ইতিহাসকারের দ্বিধা ও যুক্তি সর্বৈব ঠিক নয়। মুসলমান কবিরা যে মধ্যযুগে সবটাই ফারসি সাহিত্যের অনুগত ছিলেন–তা সত্য নয়।
আলাওলের কথিত ‘পদ্মাবতী’ কাব্যগ্রন্থটি হিন্দি ভাষায় রচিত ‘পাদুমাবৎ’ থেকে গৃহীত হয়েছে। এমনকি এই কাব্যের বিষয়ও ভারতের নিজস্ব ইতিহাসের অন্তর্গত এবং ভাষার দিক থেকে সংস্কৃতের দুহিতা। এ ধরনের বিবেচনারপরিপ্রেক্ষিতে কোলকাতা ও ঢাকার সাহিত্য ‘জল’ ও ‘পানি’ আলাদা হয়ে গেছে। জল ও পানির উৎস এক হলেও এমন কি শব্দেরবুৎপত্তিগত পার্থক্য না থাকলেও উভয় অংশের একটি বড় অংশ তৃষ্ণায় প্রাণ গেলেও জলকে পানি হিসাবে, বা পানিকে জল হিসাবেগ্রহণ করবে না।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকাররাও ওই একই ভুল করেছেন। এখানে একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই–নব্বই দশকের শুরুর দিকেবাংলা একাডেমি একটা সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারের মূল বিষয় কোলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যের ইতিহাসকারদের দ্বারা বাংলাদেশ অঞ্চলের সাহিত্যের ইতিহাস উপস্থাপনায় কার্পণ্য। মূল আলোচক ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ইতিহাস প্রণেতা–ড. ক্ষেত্রগুপ্ত। শ্রীগুপ্ত সেদিন তার আলোচনায় নির্দেশ করতে চেয়েছিলেন, এই কার্পণ্য কেবল পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের মধ্যে নয়, ঢাকার সাহিত্যিকদের মধ্যেও সমানভাবে বিদ্যমান। তিনি উদাহরণ হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত মুহম্মদ আব্দুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসানের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থটি উল্লেখ করেছিলেন। সেই গ্রন্থে রবীন্দ্র-সাহিত্যের আলোচনা মোট একুশ পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ হলেও মীর মশাররফ হোসেন-এর জন্য বরাদ্দ ছিল সাত-চল্লিশ পৃষ্ঠা। অবশ্য সেদিন তার আলোচনার জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, পাঠ্যসুচিতে মোট দশটি সহায়ক গ্রন্থের মধ্যে মাত্র একটি হলো‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ – বাকি নয়টি গ্রন্থও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পড়তে হয়। সেগুলোতে মীর মশাররফ হোসেন-এর সাহিত্যের কোনো আলোচনা নেই–এই বইতে নিয়ম রক্ষার জন্যই কেবল রবীন্দ্র-সাহিত্যের আলোচনা করা হয়েছে; কারণ রবীন্দ্র-সাহিত্য আলোচনার জন্য ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ এর চতুর্থ খণ্ড পুরোটা ছাড়াও অন্যান্য ইতিহাস বইতে ব্যাপকভাবে আছে। তাঁর ভাষ্যছিল – ১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে পূর্ব-বঙ্গীয় ছাত্রদের এ অঞ্চলের উপেক্ষিত লেখকদের জানানোর জন্য আরকোনো বই ছিল না। তাই তড়িঘড়ি করে এই বইটি লিখিত হয়েছে–মুসলিম লেখকদের জানার ক্ষেত্রে কেবল এই বইটি ব্যবহার করা হয়।
ঢাকা এবং কোলকাতার সাহিত্য একই বাংলাভাষার উত্তরাধিকার হলেও তার সাংস্কৃতিক পার্থক্য কখনো অস্পষ্ট ছিল না। আর সেখানথেকেই ‘সাহিত্যের রাজধানী হিসাবে ঢাকা’ প্রকল্পের সূচনা। দেশ বিভাগের পরে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে কোলকাতা ও ঢাকার কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে অনেক। কিন্তু এখনো সেই যোগাযোগে দু’দেশের সাহিত্যের আদানপ্রদানের চেয়ে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার খায়েশ অনেক বেশি। বিভিন্ন স্থানে সাহিত্যের অনুষ্ঠান হচ্ছে, কোলকাতা থেকে কবি সাহিত্যিক আসছেন, ঢাকা থেকে কোলকাতা যাচ্ছেন–কবিতা পড়ছেন, নিজেদের মধ্যে দুএকটা বই বিতরণ করছেন। কিন্তু দু’পক্ষের ভাষা-সাহিত্য নিয়ে খুব কমই আলোচনা হচ্ছে। ফলে দুই অংশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে অপরিচয়ের সংকট থেকেই যাচ্ছে।
Subscribe for new writing
Sign up to receive new pieces of writing as soon as they are published as well as information on competitions, creative grants and more.